“ঈশ্বরীয় বাহনকে দেখে ঈশ্বরীয় উদ্দীপন হলো-তখন আর অন্য জানোয়ার কে দেখে! সিংহ দেখেই ফিরে এলাম”- ১৮৮৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পদধূলি পড়ল আলিপুর চিড়িয়াখানায়। মাদুর্গার বাহনকে স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। আর তাকে দেখার পরে অন্য কোনও পশু-পাখি দেখার ইচ্ছে হয়নি পরমহংসদেবের। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন আলিপুর চিড়িয়াখানা।
গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকার পরে ডানদিকে যে রাস্তাটি চলে গিয়েছে, সেটি ধরে সোজা গেলে হাতির ঘেরাটোপ। সেটা পেরিয়ে আরও সোজা গেলে ডানদিকে ধনেশ পাখি-সহ অন্য পাখিদের খাঁচা। আর তার উল্টোদিকে বর্ধমান হাউজের ঠিক পিছন দিকে সিংহের (Loin) ঘেরাটোপ। সেই ঈশ্বরীয় বাহন দর্শন করতে গিয়ে সমাধিস্থ হন রামকৃষ্ণদেব। ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’-এর বিবরণ অনুযায়ী পরমহংসদেব বলছেন,
“চিড়িয়াখানা দেখতে লয়ে গিছলে। সিংহ দর্শন করেই আমি সমাধিস্থ হয়ে গেলাম। ঈশ্বরীয় বাহনকে দেখে ঈশ্বরীয় উদ্দীপন হলো-তখন আর অন্য জানোয়ার কে দেখে। সিংহ দেখেই ফিরে এলাম।“
১৮৭৫সালে তৈরি হয় আলিপুরে চিড়িয়াখানা (Alipur Zoo)। একবছর পর তা খুলে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। বারাকপুর থেকেও বেশ কিছু বন্যপ্রাণ ও পাখিদের নিয়ে আসা হয় আলিপুরে। তার মধ্য ছিল পশুরাজও। এর ঠিক আট বছর পর সেখানে এলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
কীভাবে সেই ঘটনা ঘটল?
কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে ভালবাসতেন পরমহংসদেব। তাঁর কানে এলো সিংহ (Loin) রয়েছে চিড়িয়াখানায়। ‘জগজ্জননী দেবী দুর্গার বাহন’- তাকে একবার দেখতে চান রামকৃষ্ণ। ১৮৮৪-র ফেব্রুয়ারি মাসে শিবনাথ শাস্ত্রী গিয়েছেন দক্ষিণেশ্বর। সেখানে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁকে আবদার করেন, তাঁকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়ে সিংহ দেখাতে হবে। অন্য কোনও পশুপাখি নয়, তিনি শুধু দেখবেন সোনালী কেশরের মা দুর্গার বাহনকে। আর যেন তর সয় না ঠাকুরের। ধোপদুরস্ত পোশাকে তিনি উঠে বসেন শিবনাথ শাস্ত্রীর গাড়িতে।
শিবনাথ শাস্ত্রীর সেদিন অন্য কাজের তাড়া ছিল। দক্ষিণেশ্বর থেকে সুকিয়া স্ট্রিট পর্যন্ত তিনি পরমহংসকে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে অতিপ্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রনাথের উপরই দায়িত্ব দেন সিংহ দেখানোর। স্বামী বিবেকানন্দ সেই সময় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা করেন। শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘স্বামী শিষ্য সংবাদ’ থেকে জানা যায় যে স্বামী বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতা ও স্বামী যোগানন্দকে সঙ্গে নিয়ে চিড়িয়াখানা যান পরমহংসদেব। সেই সময়কার সুপারিন্টেন্ডেন্ট রামব্রহ্ম সান্যাল রায়বাহাদুর তাঁদের অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে যান। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সেখানে ছিলেন তাঁরা।
‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’তে রামকৃষ্ণের ‘চিড়িয়াখানা দর্শন যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে লেখা শিষ্য মণিলাল মল্লিককে তিনি বলেছেন “চিড়িয়াখানা দেখাতে লয়ে ছিল। সিংহ দর্শন করেই আমি সমাধিস্থ হয়ে গেলাম! -ঈশ্বরীয় বাহন দেখে ঈশ্বরীর উদ্দীপন হলো-তখন আর অন্য জানোয়ার কে দেখে! সিংহ দেখেই ফিরে এলাম”।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। দেড়শো বছরের এই চিড়িয়াখানায় অনেক নতুন নতুন সদস্য এসেছে। সিংহের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু এখনও দর্শকদের আকর্ষণ সিংহের এই খাঁচা। যেখানে বর্ণনা রয়েছে দুর্গার বাহন দেখে পরমহংসের সমাধিস্থ হওয়ার ইতিহাস।
–
–