জীবন সোজা নয়, উৎপল সিনহার কলম 

0
3

কাছে থাকো । ভয় করছে ।

মনে হচ্ছে এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয় । ছুঁয়ে থাকো । শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত স্বজন । এই হাত , এই নাও , হাত ।

এই হাত ছুঁয়ে থাকো , যতক্ষণ কাছাকাছি আছো , অস্পষ্ট রেখো না । ভয় করে , মনে হয় , এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয় ।যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল । যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী ।

এ লেখা কি লিখতে পারেন যে কোনো কবি ? এমন লিখতে হলে নারী হতে হয় । নারী শরীর । নারী হৃদয় । নারী অস্তিত্ব । দেশকাল নির্বিশেষে এ লেখা কি সমস্ত নারীর মনের কথা নয় ?

নারীর তীক্ষ্ম আতস চোখে কিভাবে যেন ধরা পড়ে যায় সত্যের অপলাপ ।

ছোটো ছোটো মিথ্যা

জুড়ে জুড়ে

মস্ত এক সত্য গড়ে ওঠে

সেই সত্য আর সব সত্যকে

গুঁড়িয়ে মিথ্যা করে দেয় ।

সেই মিথ্যা এখন জীবন ।

কবি-দম্পতির কন্যা নবনীতা কবি হবেন উত্তরাধিকার সূত্রে , সে আর আশ্চর্য কি ?

অধ্যাপিকা , তুলনামূলক সাহিত্যে তাঁর প্রশ্নাতীত বৈদগ্ধ , তুমুল জনপ্রিয়তা ।

তবু আমৃত্যু সহজ সরল মাটির মানুষ । এই আমাদের ভালোবাসার কবি নবনীতা দেবসেন । ‘ প্রথম প্রত্যয় ‘ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ কবিতা সফর । গদ্যেও তিনি চমৎকার ।

এত ঢাকঢাক-গুড়গুড়ের

আছেটা কি মশাই

ভণ্ডামি ছেড়ে যা বলার

সোজাসুজি বলুন ।

দেখুন , জীবন সোজা নয়

জীবনে কিছুই সোজা যায় না

এমনকি হাত থেকে ঢিলটা ছুঁড়লেও সেটা প্যারাবোলা হয়ে বেঁকে পড়ে । তবে প্যারাবোলার কঠোর বাস্তব থেকে মাঝেমধ্যেই ছিটকে বেরোয় আশাবরী ছড়া ।

সোনার হরিণ হারালে হারাবো

কী আর করা ।

বৃষ্টি ঝরে না কতকাল শুধু

শুকনো খরা ।

সুতনুকা নদী শুকিয়ে হলো কি বালির চড়া ।

সোনার হরিণ সোনার হরিণ

হীরের চোখ ।

ঝরাক বৃষ্টি সোনালি ধানের

ফসল হোক ।

মূর্ত হয়ে ওঠে গোপন ব্যক্তিগত স্বপ্ন । মায়াময় ।

ভালোবাসা মাখা ।

কেউ বলুক না বলুক

তুমি সব জানো ‌।

তবু কোথাও পাহাড় আছে

ছোটো কথা , বড়ো কথা ,

ছোটো দুঃখ , বড়ো বেদনা

সব ছাড়িয়ে মস্ত এক

হাসির পাহাড় ।

একদিন সেই পাহাড়ে

ঘর বাঁধবো তোমার সঙ্গেই ।

এই কবির প্রেমিক কলকাতা।

প্রেমিকের কাছে পেশ করেন সর্বস্ব সমর্পনের আর্জি । প্রেমিকের বিরহদশা সহ্য হয় না তাঁর ।

আবার সময়-সমাজ-দেশকাল নিয়ে কবির উদ্বেগ বড়ো কম নয় ।

লিখে চলেন অস্থির , চুড়ান্ত বিপথগামী সময়ের ভাষ্য । শেষে কার জয় ? আলোর ? নাকি অন্ধকারের ? লিখে ফেলেন মনের কথা ।

কী পাইনি সেটা দেখতে গেলেই দুঃখ । কী দিইনি সেটা দেখতে হয় , সেখানেই সুখ । যে-কোনো মানবিক সম্পর্কের গোড়ার কথা এবং শেষের কথা এইটে ।

পাওয়াটা তোমার নিজের হাতের মধ্যে নয় , দেওয়াটা নিজের ক্ষমতার মধ্যে ।

সূর্যদেবকে কবি মনে করান

কুন্তির কথা ।

কামনা করেন সমকালের মানবসভ্যতার সুস্থতা ।

শুধু তুমি সুস্থ হবে ।

আমি দিয়ে দেবো আমার

কোজাগরীর চাঁদ ,

শাদা দেওয়ালের

ময়ূরকণ্ঠী আলো ,

দিয়ে দেবো বিগত বছরের

মরা পাখির মমতা ,

আর আগামী বছরের

কলাগাছটির স্বপ্ন ।