কাছে থাকো । ভয় করছে ।
মনে হচ্ছে এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয় । ছুঁয়ে থাকো । শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত স্বজন । এই হাত , এই নাও , হাত ।
এই হাত ছুঁয়ে থাকো , যতক্ষণ কাছাকাছি আছো , অস্পষ্ট রেখো না । ভয় করে , মনে হয় , এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয় ।যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল । যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী ।
এ লেখা কি লিখতে পারেন যে কোনো কবি ? এমন লিখতে হলে নারী হতে হয় । নারী শরীর । নারী হৃদয় । নারী অস্তিত্ব । দেশকাল নির্বিশেষে এ লেখা কি সমস্ত নারীর মনের কথা নয় ?
নারীর তীক্ষ্ম আতস চোখে কিভাবে যেন ধরা পড়ে যায় সত্যের অপলাপ ।
ছোটো ছোটো মিথ্যা
জুড়ে জুড়ে
মস্ত এক সত্য গড়ে ওঠে
সেই সত্য আর সব সত্যকে
গুঁড়িয়ে মিথ্যা করে দেয় ।
সেই মিথ্যা এখন জীবন ।
কবি-দম্পতির কন্যা নবনীতা কবি হবেন উত্তরাধিকার সূত্রে , সে আর আশ্চর্য কি ?
অধ্যাপিকা , তুলনামূলক সাহিত্যে তাঁর প্রশ্নাতীত বৈদগ্ধ , তুমুল জনপ্রিয়তা ।
তবু আমৃত্যু সহজ সরল মাটির মানুষ । এই আমাদের ভালোবাসার কবি নবনীতা দেবসেন । ‘ প্রথম প্রত্যয় ‘ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ কবিতা সফর । গদ্যেও তিনি চমৎকার ।
এত ঢাকঢাক-গুড়গুড়ের
আছেটা কি মশাই
ভণ্ডামি ছেড়ে যা বলার
সোজাসুজি বলুন ।
দেখুন , জীবন সোজা নয়
জীবনে কিছুই সোজা যায় না
এমনকি হাত থেকে ঢিলটা ছুঁড়লেও সেটা প্যারাবোলা হয়ে বেঁকে পড়ে । তবে প্যারাবোলার কঠোর বাস্তব থেকে মাঝেমধ্যেই ছিটকে বেরোয় আশাবরী ছড়া ।
সোনার হরিণ হারালে হারাবো
কী আর করা ।
বৃষ্টি ঝরে না কতকাল শুধু
শুকনো খরা ।
সুতনুকা নদী শুকিয়ে হলো কি বালির চড়া ।
সোনার হরিণ সোনার হরিণ
হীরের চোখ ।
ঝরাক বৃষ্টি সোনালি ধানের
ফসল হোক ।
মূর্ত হয়ে ওঠে গোপন ব্যক্তিগত স্বপ্ন । মায়াময় ।
ভালোবাসা মাখা ।
কেউ বলুক না বলুক
তুমি সব জানো ।
তবু কোথাও পাহাড় আছে
ছোটো কথা , বড়ো কথা ,
ছোটো দুঃখ , বড়ো বেদনা
সব ছাড়িয়ে মস্ত এক
হাসির পাহাড় ।
একদিন সেই পাহাড়ে
ঘর বাঁধবো তোমার সঙ্গেই ।
এই কবির প্রেমিক কলকাতা।
প্রেমিকের কাছে পেশ করেন সর্বস্ব সমর্পনের আর্জি । প্রেমিকের বিরহদশা সহ্য হয় না তাঁর ।
আবার সময়-সমাজ-দেশকাল নিয়ে কবির উদ্বেগ বড়ো কম নয় ।
লিখে চলেন অস্থির , চুড়ান্ত বিপথগামী সময়ের ভাষ্য । শেষে কার জয় ? আলোর ? নাকি অন্ধকারের ? লিখে ফেলেন মনের কথা ।
কী পাইনি সেটা দেখতে গেলেই দুঃখ । কী দিইনি সেটা দেখতে হয় , সেখানেই সুখ । যে-কোনো মানবিক সম্পর্কের গোড়ার কথা এবং শেষের কথা এইটে ।
পাওয়াটা তোমার নিজের হাতের মধ্যে নয় , দেওয়াটা নিজের ক্ষমতার মধ্যে ।
সূর্যদেবকে কবি মনে করান
কুন্তির কথা ।
কামনা করেন সমকালের মানবসভ্যতার সুস্থতা ।
শুধু তুমি সুস্থ হবে ।
আমি দিয়ে দেবো আমার
কোজাগরীর চাঁদ ,
শাদা দেওয়ালের
ময়ূরকণ্ঠী আলো ,
দিয়ে দেবো বিগত বছরের
মরা পাখির মমতা ,
আর আগামী বছরের
কলাগাছটির স্বপ্ন ।